বসন্তবরণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে গদখালীর ফুলচাষিরা নতুন উপহার হিসেবে এনেছিলেন ‘লং স্টিক রোজ’। ভারতের পুনে থেকে চারা এনে ৪০ শতক জমিতে দেশে প্রথমবারের মতো বিশেষ ধরনের গোলাপের জাতটির চাষ শুরু করেছিলেন যশোরের গদখালীর ইনামুল হোসেন। অন্য জাতের গোলাপ ফুল গাছ থেকে তোলার পর যেখানে ৪-৫ দিনের বেশি রাখা যায় না, সেখানে লং স্টিক গোলাপ রাখা যায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। এর স্টিক বেশ শক্ত। দামও মিলছে দ্বিগুণ। এসব কারণে ইনামুলের দেখাদেখি এ অঞ্চলের বেশিরভাগ চাষির মাঠে শোভা পাচ্ছে গোলাপের নতুন এই জাত।
এবার নতুন জাতের ফুল উপহার দিতে না পারলেও এখানকার চাষিরা ফুলপ্রেমীদের দিচ্ছেন চমকপ্রদ খবর। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জারবেরা চারায় ফুল ফোটাতে যাচ্ছেন তারা। এ গাছে আগামী বাংলা নববর্ষের আগেই ফুল ফুটবে বলে আশা করছেন চাষিরা। এতদিন বেঙ্গালুরু থেকে চারা এনে জারবেরা চাষ করতেন চাষিরা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আরআরএফ যশোরের টিস্যু কালচার সেন্টার জারবেরার চারা তৈরি করছে।
এবার নতুন জাতের ফুল না এলেও এখন প্রস্তুতি চলছে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ফাগুন উৎসব ও ভালোবাসা দিবস এবং মহান ভাষা দিবসকে সামনে রেখে ফুল চাষের। ফুলের রঙে রঙিন হয়েছে ‘ফুলের রাজধানী’ খ্যাত গদখালী। ফুলের বাগানে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এখন ফুলের ভরা মৌসুম; আর ধরতে হবে তিনটি উৎসব। সে কারণেই এত তোড়জোড় তাদের।
‘লং স্টিক রোজে’র পাশাপাশি গদখালী-পানিসারা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন দোল খাচ্ছে জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা ও চন্দ্রমলিল্গকাসহ হরেক রকমের ফুল। বাতাসে ফুটন্ত ফুলের সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় ফুলের হাসি লেগেছে চাষিদের চোখেমুখেও।
পানিসারার ফুলচাষি সাহিদা বেগম বলেন, এখন চাষিরা গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রেখেছেন, এতে ফুল একটু দেরিতে ফোটে। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় পাঁচ টাকার মতো। যদি ৮-১০ টাকা বিক্রি করা যায়, তাহলে মুনাফাও হবে ভালো। জারবেরা ফুল ব্যবসায়ী রনি ইসলাম বলেন, এখন প্রতি সপ্তাহে ৬-৭ হাজার পিস ফুল বিক্রি হচ্ছে। সামনের উৎসব সামনে রেখে তারা তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন। গদখালীর ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, পৈতৃক জমিতে তিনি আগে ধান-পাট ও রবিশস্যের আবাদ করতেন। এখন সেখানে ফুল চাষ করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হয়েছেন।
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, এবার জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগের বেশি যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফুল এখন যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ায়ও।
অন্যদিকে ইউরোপের বাজারে ফুল রপ্তানির আশায় পলি হাউসে ফুলের আবাদ করছেন এখন চাষিরা। তারা বলছেন, পলি হাউসে তাপমাত্রা সঠিক মাত্রায় থাকার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী গোলাপ ফুল উৎপাদন হবে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ৫-৬ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। দাম বাড়ার কারণে এবার ২০ কোটি টাকা বিক্রি ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দেশে ফুলের বিশাল এই বাণিজ্যও শুরু হয়েছিল জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারাতে। আশির দশকে এই গ্রামে প্রথম শুরু হয়েছিল বাণিজ্যিক ফুল চাষ। এখানকার ফলদ ও বনজ গাছের নার্সারির মালিক শের আলী গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন ফুল চাষের।