স্বাধীনতা শব্দটি প্রতিটি পরাধীন জাতির জন্য সবচেয়ে কাক্সিক্ষত চাওয়া, সবচেয়ে বড় অর্জন। পরাধীন থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত থাকে সে দেশের মানুষের চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, নির্যাতিত মানুষের চিৎকার, ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন এবং এক নদী রক্ত। বাংলাদেশ ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ রকম মহান ইতিহাস। আমাদের বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর ঘৃণা এবং বাঙালির অর্জন নিয়ে বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে। সেসব সাহিত্যে রয়েছে বাঙালির নির্যাতন আর বীরত্বের কথা। অনেক কবিতা, গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, নাটক তৈরি হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত কবিতা রচিত হয়েছে তার মধ্যে শামসুর রাহমানের কবিতা নিঃসন্দেহে অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য। তার বেশকিছু কবিতা মানুষের মুখে মুখে। শামসুর রাহমানের কবিতা সব প্রজন্মের কাছে সমান অনুপ্রেরণাদায়ী। দেশকে ভালোবাসতে যুগে যুগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কবি শামসুর রাহমানকে আমরা ব্যস্ত নাগরিক জীবনের কবি হিসেবেই বেশি চিনতে পারি। তিনি ছিলেন একজন সমকালের সমাজ সচেতন কবি। তার চারপাশের অভিজ্ঞতা, নাগরিক জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রোমান্টিকতা, প্রেম, নৈসর্গিকতা, শাসন-শোষণ আর শোষকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও তীব্র ক্ষোভ এসব নিয়েই তিনি লিখেছেন কবিতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকেই লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অন্যতম জনপ্রিয় সব কবিতা।
২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলার বুকে যে নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, সেসব ঘটনায় কবিতার শব্দে স্থান পেয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাসের অত্যাচারের করুণ চিত্র বর্ণনা করেছেন তার ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশে। তার মাতৃভূমিকে যারা গোরস্থানে পরিণত করেছে তাদের তিনি অভিশাপ দিয়েছেন। তার ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ কাব্যগ্রন্থে ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতাটি সেই গণহত্যাকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতার প্রথম কয়েক লাইনেই তিনি লিখেছেন, ‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে/অভিশাপ দিচ্ছি/আমাদের বুকের ভেতর যারা/ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিল সেঁটে/মগজের কোষে কোষে যারা/ পুঁতেছিল আমাদেরই আপনজনের লাশ…।’ এই কবিতার প্রতিটি লাইন এক একটি প্রতিবাদ, এক একটি ঘৃণার বাক্যবাণ। প্রতিটি শব্দ যেন পাক বাহিনীর অত্যাচারের প্রতি নির্দেশ করে।
শামসুর রাহমান আধুনিক প্রধানতম কবিদের ভেতর গণ্য। কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। স্বাধীনতা নিয়ে যত কবিতা, গল্প রচিত হয়েছে তার মধ্যে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটির বৈশিষ্ট্য অনবদ্য। কবিতাদ্বয় যুগল কবিতা নামে সমধিক পরিচিত। কাব্যের ভেতরেও কী চমৎকারভাবে স্বাধীনতার আকুতি, স্বাধীনতা পাওয়ার পথের বাধা, স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ, স্বাধীনতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতা যে কেবল একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ নয় বা কোনো গ-িতে আবদ্ধ নয় তাও স্পষ্ট এই ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়। তাই এই কবিতাখানি যে যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরকে স্বাধীনতার প্রকৃত উপলব্ধি পেতে সাহায্য করবে তা বলাই বাহুল্য। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতাকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। কোথাও স্বাধীনতাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সরলভাবে। মাঠ ভরা ফসল বাংলার চিরায়ত রূপ। এই চিরায়ত রূপকেই তিনি কবিতায় স্বাধীনতার উপজীব্য করেছেন। মাঠ ভরা ফসল দেখে কৃষক যেমন আনন্দিত হয়, তার পরিশ্রমের ফসল মাঠে বাতাসে মাথা দোলাতে দেখে যে আনন্দ হয়, সেই আনন্দঘন মুহূর্ত স্বাধীনতা। তাই বললেন, ‘স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি’। তিনি এ কবিতায় স্বাধীনতাকে কখনও গ্রাম্য মেয়ের মধ্যপুকুরে অবাধ সাঁতার, কখনও মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি, কোথাও তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর তেজদীপ্ত ভাষণের কণ্ঠস্বর, কালবৈশাখী ঝড়, শ্রাবণে অকুল মেঘনার কুল অথবা উঠানে মায়ের ছড়ানো শুভ্র শাড়ির আঁচল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এত সহজ, এত চমৎকার করে যে স্বাধীনতাকে ফুটিয়ে তোলা যায় সে কথা কতজন ভেবেছে। একটি কবিতার মাধ্যমে স্বাধীনতার সব দিক তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। কবিতার লাইনের মাধ্যমে এত সুন্দর স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তা কেবল এই কবিতা পাঠ করলেই বোঝা সম্ভব। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার স্বরূপ এবং এর স্বাদ কেমন হওয়া উচিত তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কবিতার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে গৌরবম-িত করা হয়েছে। স্বাধীনতার এমন সহজ ব্যাখ্যা আমি খুব কমই চোখে দেখেছি। বিশেষত কবিতার ভাষায় নিখুত বর্ণনায়।
অস্ত্র হাতে কবি যুদ্ধ করেননি। তার হাতে ছিল কলম। তার চোখে ছিল ঘৃণা, তার চোখে ছিল প্রতিবাদ, তার চোখে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিই যে কবির কাছে বড় প্রিয় ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তার মাতৃভূমি মুক্তি পাক, তার স্বদেশভূমি থেকে দস্যুরা ধ্বংস হোক। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম কবির কবিতায় বারবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানিদের বীভৎস নির্যাতন, অত্যাচারের বাস্তব চিত্র এসব কবিতা। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহ যা বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা শামসুর রাহমানের কবিতায় ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। যার উদাহরণ কবির ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে/সালামের মুখ আজ আলোকিত ঢাকা/সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা/দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারণ/দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা/আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে/এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে/ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে।’
১৯৬৯ সালে তিনি মিছিলে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে লিখে ফেলেন অমর কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। এই কবিতায় শেষে লিখলেন, ‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ কি সাহসী উচ্চারণ এক একটি শব্দে। যেন বুলেটের মতো শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশজুড়ে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে তখন চারদিকে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ। চারদিকে রাইফেলের আওয়াজ, মানুষের আর্তনাদ, রক্তের গন্ধ। মুক্তিকামী জনতা তখন মুক্তির জন্য পাগল। তারাও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্থ করে দিচ্ছে। কবি লিখলেন, ‘অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গি জিপ। আর্ত/শব্দ সবখানে। আমাদের দুজনের/মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো/…দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।’ (তুমি বলেছিলে; বন্দি শিবির থেকে)
কবির স্বাধীনতা নিয়ে লেখা আর একটি কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি জাতির বা কোনো ব্যক্তির ত্যাগ কতটা এবং সত্যিকার অর্থে কতটা ত্যাগ স্বীকার করলে স্বাধীনতা অর্জিত হয় তা বর্ণনা করেছেন। দুই কবিতাই গদ্যধর্মী এবং স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতার প্রথম লাইনেই তিনি লিখেছেন, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?’ এই লাইনের পরেই তিনি লিখেছেন, ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল।’ এরকম কত সাকিনার কপাল ভেঙেছে পাকিস্তানিরা তার হিসাব নেই। এক সাকিনাকে দিয়ে সব সাকিনার দুর্দশার কথা বর্ণনা করেছেন নিপুণভাবে। কবিতাটির কোনো কোনো অংশে স্বাধীনতার সেই সময়কার কিছু ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাংক এলো/দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/…মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।’ এসব লাইন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনের সেই ভয়াল দিনগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। নাগরিক জীবনের সুখ দুঃখ এবং দৈনন্দিন উপাদানের উপস্থিতি নিয়েও সযতেœ কবিতা লিখে গেছেন। তাই তো তিনি নাগরিক কবি নামে পরিচিত হয়েছেন। হয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়।
কবির অনেক কবিতায় ফুটে উঠেছে যান্ত্রিক শহরের একঘেয়ে ক্লান্তি, নৈরাশ্যবাদ এবং নাগরিক জীবনের সব উপাদান। শামসুর রাহমান একজন প্রতিবাদী ও দেশপ্রেমিক কবি। তার সৃষ্ট সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে সাহিত্য ভা-ারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখিয়েছেন।