‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সাক্ষাৎ চাইলেন টিউলিপ সিদ্দিক
আন্তর্জাতিক ডেক্স :
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য এবং সদ্য সাবেক অর্থ সচিব টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত নাম হয়ে উঠেছেন একাধিক বিতর্ক ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে। সেই বিতর্কের কেন্দ্রেই এখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ চান—বিশেষত তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ তৈরি হয়েছে, তা নিরসনের লক্ষ্যে।
টিউলিপ, যিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি, এবং যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেট আসনের জনপ্রতিনিধি, জানিয়েছেন—তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’।
দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে টিউলিপ নিজে থেকেই যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীদের মানদণ্ড বিষয়ক উপদেষ্টা লর্ড ম্যাগনাসের কাছে নিজের বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ করেন।
তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও, ব্রিটিশ মন্ত্রিপরিষদের উচ্চ নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখার প্রয়োজনে তিনি অর্থ সচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এই ঘটনায় অনেকে টিউলিপের পদত্যাগকে আত্মসমালোচনার নজির হিসেবে দেখলেও, সমালোচকরা বলছেন—এটি ছিল তাঁর এবং বাংলাদেশি রাজনীতিতে তাঁর পরিবারের অবস্থান নিয়ে যুক্তরাজ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ইঙ্গিত।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ করে, টিউলিপ সিদ্দিক কিংবা তাঁর মা অবৈধভাবে ঢাকায় ৭,২০০ বর্গফুটের একটি প্লট বরাদ্দ পান।
টিউলিপের ভাষ্য অনুযায়ী, এই অভিযোগের ভিত্তি নেই, বরং এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। তিনি বলেন,
“আমার আইনজীবীদের সঙ্গে দুদক কখনোই যোগাযোগ করেনি। ঢাকার একটি অজানা ঠিকানায় নোটিস পাঠানো হয়েছে, যার সঙ্গে আমার কোনো সংযোগ নেই।”
এদিকে, সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ববি হাজ্জাজ নামের এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে দুদক শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি তদন্ত পরিচালনা করছে, যার মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিকের নামও উঠে এসেছে।
এমনকি টিউলিপের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার খবরও ছড়িয়েছে, যদিও তিনি তা জানেন না এবং আদালতের কোনো নোটিসও পাননি বলে দাবি করেছেন।
টিউলিপ সিদ্দিক স্পষ্ট করেছেন—তিনি জন্ম ও বেড়ে ওঠেছেন যুক্তরাজ্যে, এবং তাঁর কর্মক্ষেত্রও এখানেই।
“বাংলাদেশ আমার হৃদয়ের খুব কাছের, কিন্তু সেটি আমার জন্মস্থান নয়, কর্মক্ষেত্রও নয়।”
তাঁর মতে, শুধু পারিবারিক পরিচয়ের কারণে তাকে যেসব দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে, তা অযৌক্তিক এবং দুঃখজনক।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এখন যুক্তরাজ্য সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে তাঁর রাজা চার্লস এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
এই সফরের সুযোগেই টিউলিপ সিদ্দিক একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাতের অনুরোধ করেছেন ইউনূসের কাছে।
চিঠিতে টিউলিপ লিখেছেন:
“আমি আশা করি, এই সাক্ষাৎ আমাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে ঢাকার দুদকের মিথ্যা দাবি—আমি কোনোভাবে শেখ হাসিনার সরকারের সুবিধাভোগী—তা নিরসনে সহায়ক হবে।”
এই ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি বড় চিত্র তুলে ধরছে। যেখানে পরিবার, বিদেশি সম্পৃক্ততা, দুর্নীতির অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান—সবকিছু একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে আছে।
টিউলিপ সিদ্দিক হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরাসরি জড়িত নন, কিন্তু পারিবারিক পরিচয় এবং ব্রিটিশ রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান তাঁকে সেই বাস্তবতার অপ্রত্যাশিত অংশ করে তুলেছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের এই সংলাপ-প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে একটি নতুন পর্বের সূচনা করতে পারে—যেখানে সংঘর্ষের বদলে সংলাপ, অভিযোগের বদলে ব্যাখ্যা এবং সম্পর্ক নষ্ট করার বদলে তা জোড়া লাগানোর চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন রয়ে যায়—এই অনুরোধে ড. ইউনূস কী সাড়া দেবেন?
আর ভবিষ্যতে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনীতি এবং প্রবাসী রাজনীতিকদের জন্য কী বার্তা বয়ে আনবে, তা সময়ই বলে দেবে।
সংবাদ উৎস: দ্য গার্ডিয়ান (৮ জুন ২০২৫)