সিংগাতী সার্বজনীন মন্দিরে শান্তি সস্তায়ন, শীতলা পূজা, কালীপূজা ও কবি গানের মহোৎসব
– আজীজুল রহমান, মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার, বাগেরহাট
বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সিংগাতী সার্বজনীন পূজা মন্দির কমপ্লেক্সে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো এক অনন্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এই আয়োজনে একত্রে পালিত হয়েছে বার্ষিক শান্তি সস্তায়ন, শীতলা পূজা এবং কালীপূজা, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল লোকসংস্কৃতির প্রাণ—কবি গানের মহোৎসব। উৎসবটি স্থানীয় জনগণের মধ্যে যেমন ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও আত্মিক প্রশান্তি এনে দিয়েছে, তেমনি সংহতি, সম্প্রীতি ও সংস্কৃতির এক গভীর বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র।
পূজাকে ঘিরে সৃষ্টি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশ, যেখানে হাজারো মানুষের ঢল নামে মন্দির প্রাঙ্গণে। সকাল থেকেই ধর্মীয় আচারে ভক্তরা অংশ নেন; কেউ উপবাস পালন করেন, কেউ আবার পুষ্পাঞ্জলি, প্রদীপ প্রজ্বালন এবং সন্ধ্যা আরতিতে অংশ নেন। ধূপ-ধুনোর সুগন্ধে, মন্ত্রোচ্চারণে ও ঘণ্টার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা মন্দির এলাকা।
আয়োজনের অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ ছিল কবি গানের মহোৎসব, যেখানে যশোরের প্রিতিশ সরকার এবং বটিয়াঘাটার শ্যাম সরকার তাঁদের অসাধারণ কণ্ঠে পরিবেশন করেন গ্রামীণ বাংলার জীবনের গল্প, ধর্মীয় ভাবধারা এবং সমাজবাস্তবতা। তাঁদের সুর ও বাণীতে দর্শক-শ্রোতা অভিভূত হয়ে যান। শুধু গান নয়—এ যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, এক লোকজ দর্শন, যা মঞ্চ থেকে নেমে গিয়ে দর্শকদের হৃদয়ে ছাপ ফেলে।
পুরো মন্দির চত্বরটি ছিল রঙিন আলোকসজ্জা, ফেস্টুন ও ফুলে সজ্জিত। শিশুদের জন্য ছিল ছোটখাটো খেলনার দোকান, খাবারের স্টল, এবং নানা লোকজ সামগ্রী। গোটা অনুষ্ঠানটির সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় ছিলেন পূজা পরিচালনা কমিটি।
এই কমিটির নেতৃত্ব দেন আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে। তাঁর দক্ষ পরিচালনা এবং দলের নিরলস পরিশ্রমে আয়োজনটি হয় সম্পূর্ণ সফল। কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—বরুণ কুমার দাস, মধুসূদন চক্রবর্তী, শেখর ব্যানার্জী, রাহুল রায় চৌধুরী, দূর্জয় কুমার দে, অনুপ শীল, সাগর কুমার দাস, আকাশ কুমার দে, সৌরভ কুমার দাস ও বাঁধন কুমার দাস। তাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করে এক অপূর্ব আয়োজন নিশ্চিত করেন।
এই পূজা ও উৎসব কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি হয়ে উঠেছিল সর্বধর্মের মানুষের মিলনমেলা। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এবং মুসলিম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। ধর্মীয় ভেদাভেদ পেরিয়ে এক সামাজিক ঐক্য এবং সৌহার্দ্য যেন এই আয়োজনের মুখ্য বার্তা হয়ে ওঠে।
অনুষ্ঠানে আগত দর্শনার্থীরা জানান, “এই পূজা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ার স্থান। এখানে আমরা ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে যাই।” এক প্রবীণ দর্শনার্থীর মন্তব্য, “এ যেন শুধু পূজার অনুষ্ঠান নয়, একটি লোকজ মিলনমেলা।” যুবসমাজের একজন বলেন, “আমাদের সংস্কৃতির গৌরব এখানেই—যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি হাতে হাতে চলে।”
সিংগাতী সার্বজনীন পূজা মন্দির কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত এই পূজা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন প্রমাণ করে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান কেবল আধ্যাত্মিক উন্নয়ন নয়—সামাজিক বন্ধন, সহনশীলতা এবং সংস্কৃতির পুনর্জাগরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই ধরনের সমন্বিত আয়োজন বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ুক—এই প্রত্যাশা স্থানীয় জনগণসহ সকল অতিথির মুখে মুখে। এটি যেন হয়ে ওঠে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনের এক অনুপ্রেরণা।