অঝরে একটি ফুলের অকাল ঝরে পড়া — দুর্ঘটনা, নাকি রহস্য? সমাজ কি নিরুত্তর?
রায়হান হোসেন
স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সংবাদ ৭১
যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার নাভারণ ইউনিয়নের বায়সা-চাঁদপুর ওয়ার্ডের চাঁদপুর গ্রাম। এই গ্রামেই বসবাস করেন ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল। তার কোলজুড়ে জন্ম নেওয়া ১১ বছরের ফুটফুটে মেয়ে সোহানা আক্তার—এই বয়সেই তার হাসিতে ভরে উঠতো পুরো বাড়ি। সে ছিল বায়সা চাঁদপুর দাখিল মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ঈদের আনন্দে মেতে ওঠার কথা ছিল, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা ছিল, কিন্তু এই ঈদে সোহানার জীবনের গল্পটা থেমে গেল চিরতরে।
গতকাল, ঈদের দিন, বিকেল ৩টার দিকে সোহানা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। গন্তব্য ছিল হাড়িয়া-পানিসারা ফুলমোড়ের দিক। পরিবার ভেবেছিল, ঈদের খুশি ভাগ করে নিতে কারো বাড়িতে যাচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতে থাকে, রাত পেরিয়ে যায়—সোহানা আর ফিরে আসে না। উদ্বিগ্ন পরিবারের সদস্যরা, প্রতিবেশীরা খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। কিন্তু কোনো খোঁজ মেলে না।
পরদিন সকালে, সেই আশঙ্কা সত্যি হয়—সোহানার নিথর দেহ উদ্ধার হয় হাড়িয়া-মানিকালি গ্রামের একটি পুকুর থেকে। খবর ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই, স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা গ্রাম। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন—কীভাবে মারা গেল এই নিষ্পাপ শিশুটি?
এই মৃত্যু নিছক একটি দুর্ঘটনা কি? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর কোনো চক্রান্ত, বর্বরতা?
একটি ১১ বছরের শিশু, যার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন এখনও আঁকা হয়নি, সেই কি এমনভাবে হারিয়ে যেতে পারে?
এলাকার মানুষ দিশেহারা, আতঙ্কিত।
একজন অভিভাবক বলেন,
“যেখানে আমাদের সন্তানরা নিজ এলাকায়ও নিরাপদ নয়, সেখানে আমরা কিভাবে তাদের বড় করব? এটা দুর্ঘটনা না, এটা একটা বার্তা—আমরা সবাই বিপদে আছি।”
যে সমাজে শিশুরা নিরাপদ নয়, সে সমাজ কি সত্যিই সভ্য?
এই প্রশ্ন আজ শুধু চাঁদপুর গ্রামে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।
সোহানার মৃত্যু যদি নিছক পানিতে ডুবে যাওয়া হতো, তাহলে তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল কি না, সে প্রশ্ন আসতো না।
কিন্তু এলাকায় ফিসফাস চলছে—“সোহানাকে কেউ ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কি? তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে কি?”
এ প্রশ্নের উত্তর চাই।
আমরা চাই তদন্ত হোক, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রকাশ হোক, প্রকৃত তথ্য সামনে আসুক।
এটা কেবল একটি পরিবারের আহাজারি নয়—এটা পুরো সমাজের কাছে এক কঠিন প্রশ্ন:
“আর কত ফুল অকালে ঝরে পড়বে?”
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমাদের আহ্বান—
এই মৃত্যু যেন শুধুই আরেকটি ‘দুর্ঘটনা’ বলে এড়িয়ে না যাওয়া হয়।
আমরা চাই,
এই ঘটনায় শুধু সোহানার প্রাণহানিই ঘটেনি—এই সমাজের বিবেকও রক্তাক্ত হয়েছে।
একটি শিশু আর তার পরিবারের রঙিন স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
এই মৃত্যু আমাদের ভাবায়, কাঁদায় এবং জাগিয়ে তোলে একটাই প্রশ্নে—
“আমরা কি এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে ঈদের দিনেও শিশুরা নিরাপদ নয়?”
আজ সোহানার জন্য আমরা শোক জানাই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি, আমরা চাই ন্যায়বিচার।
কারণ, অন্যথায় আগামীকাল হয়তো আরেকটি ফুল ঝরে যাবে—আর আমরা তাকিয়ে থাকব আবারও নিরুত্তর সমাজের দিকে।