সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব এক মাসেই, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দাবি বিএনপির; পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের আহ্বান এনসিপির
হারুন অর রশিদ, স্টাফ রিপোর্টার:
জাতীয় নির্বাচন যেন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এবং তার আগে জরুরি সংস্কার বাস্তবায়ন হয়—এমন অভিন্ন বার্তা দিয়েছেন দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। পাশাপাশি তারা বলছেন, ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার আগে কোনোভাবেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা ঠিক হবে না। কারণ, একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই তারিখ ঘোষণা সংস্কারের ভিত্তি দুর্বল করে দেবে।
সোমবার (২ জুন) রাজধানীর বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে এই মত দেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আলোচনার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা মনে করি, ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। এমন কোনো সংস্কার নেই, যা এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন যেগুলোর ক্ষেত্রে নেই, সেইসব সংস্কার নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কাজেই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কোনো বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা নেই।”
তিনি আরও বলেন, “এ বিষয়টি আমরা বৈঠকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এবং প্রায় সব দলের বক্তব্যেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতি সমর্থন দেখা গেছে। আমরা আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা একটি নিরপেক্ষ ও দায়বদ্ধ ভূমিকায় বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।”
সালাহউদ্দিন আহমদ সংলাপ প্রসঙ্গে বলেন, “গণতন্ত্র মানেই মতের বৈচিত্র্য। তাই সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন, এমনটা নয়। তবে আলোচনার মধ্য দিয়ে একাধিক বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব। এটি একটি বড় অর্জন।”
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, সংস্কারপ্রক্রিয়া যদি সার্থক হয়, তাহলে তা জুলাই মাসেই একটি ঐকমত্যভিত্তিক সনদের মাধ্যমে জনগণের সামনে আসবে। এই সনদ ঘোষণার আগে যদি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেটি একটি রাজনৈতিক চাপের পরিবেশ তৈরি করবে এবং পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়াকে দুর্বল করবে।”
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা সরকারকে আরও দুই মাস সময় দিতে প্রস্তুত। আমরা চাই, জুলাই সনদে স্পষ্টভাবে ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থার কাঠামো, নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতার ভারসাম্যসহ মৌলিক বিষয়ের সংস্কার সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হোক। জনগণ বুঝুক, তারা কিসের পক্ষে ভোট দেবে।”
তিনি আরও জানান, এনসিপির পক্ষ থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি তোলা হয়েছে— ১. ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন,
২. সনদ ঘোষণার আগেই নির্বাচন ঘোষণা না করা,
৩. নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনী আইনের কাঠামোগত সংস্কার ও কমিশনের পুনর্গঠন।
নাহিদ বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, জানুয়ারিতে একটি তারিখ ঘোষণা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবার আর কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ চাই না। আমরা চাই, জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি দৃশ্যমান রূপরেখা প্রকাশ পাবে এবং তার পরেই নির্বাচনের ঘোষণা আসবে।”
সোমবারের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। জামায়াতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ। গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
এই বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা জানান, সংস্কারপন্থী কমিশনগুলো বিশেষ করে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কারের জন্য ১৬৬টি প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে চলছে সংলাপের দ্বিতীয় পর্ব।
এর আগে, ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রথম পর্বে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে। আলোচনায় যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা যায়, এবার তার সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে। মূল লক্ষ্য, আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা।
বিশ্লেষণ:
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে উদ্বেগ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে আশাবাদও। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ, সংস্কারে নমনীয়তা এবং ঐকমত্যের প্রতি আগ্রহ—সব কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে একটি নতুন সম্ভাবনার। তবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দরকার কার্যকর ও সময়মতো সিদ্ধান্ত। জুলাই সনদ কি কেবল একটি কাগুজে দলিল হবে, না কি তা ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামোর মাইলফলক হবে—তা নির্ভর করছে আসন্ন দিনগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কৌশলের ওপর।