সীমান্ত মানুষের রক্ষার দেয়াল ‘নাফনদ’
টেকনাফ কক্সবাজার প্রতিনিধি
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কক্সবাজারের টেকনাফ কোলঘেঁষে বয়ে গেছে নাফ নদ। এ নাফ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ভাগ করেছে। গত ছয় মাস ধরে টানা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের তীব্রতায় আতঙ্কের জীবন যাপন করছেন টেকনাফের নাফনদের সীমান্তের বসবাসকারীরা। ওপাড়ে নাফের কাছাকাছি কয়েক লাখ মানুষের বসতি।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর কক্সবাজারের টেকনাফের কয়েকটি পয়েন্ট মিয়ানমারের যুদ্ধের গোলার শব্দে এপাড়ে সীমান্ত কেঁপে উঠেছে। তবে বান্দরবানের মতো স্থলসীমানা না হওয়ায় টেকনাফের চার কিলোমিটার প্রস্থ নাফনদ সীমান্ত ববাসকারী মানুষদের রক্ষা দেয়াল হয়ে দাড়িঁয়ে আছে। ফলে এই নাফনদ সীমান্তবর্তী বসবাসকারী মানুষকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে।
জানতে চাইলে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মজিবুর রহমান বলেন,‘কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আবার ওপাড়ের বিকট শব্দে মর্টার শেল ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটছে। এতে সীমান্তের ১০-১২টি গ্রামের বসবাসকারী মানুষরা আতঙ্কেও মধ্য থাকে। তবে আমাদের সীমান্তে নাফনদ থাকায় এখনো মিয়ানামারের চলমান যুদ্ধে এপাড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কেননা সেদেশের যুদ্ধকালীন বান্দরবানের তুমব্রæতে বাংলাদেশী প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। সেহিসেবে এই নাফনদ আমাদের রক্ষার দেয়াল হিসেবে কাজ করছে।’
এদিকে গত ২১ জুলাই ওপারের চারটি গুলি এসে পড়ে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপে। দুটি গুলি পড়েছে শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রি ও জেটিঘাট এলাকার হোছন আলীর দোকানের সামনে। একটি পড়েছে শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিসের বাড়ির আঙিনায় এবং আরেকটি পড়েছে একই পাড়ার মোহাম্মদ আয়াসের বসতবাড়ির সামনের পিলারে। তাতে পিলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বসতবাড়িতে গুলি এসে পড়ার বিষয়ে মোহাম্মদ আয়াজ বলেন, সেদিন সকালে বাড়িতে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এসময় মিয়ানমারের দিক থেকে একটি গুলি এসে আমার বাড়ির সামনের দেয়ালে লাগে। এতে দেয়ালের আস্তরণ উঠে ফাটল ধরে। গুলিটি খুব দ্রæত বেগে এসেছিল। কারো গায়ে পড়লে বড় ধরনের জখম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের এলাকার দূরত্ব কমপক্ষে ৫ কিলোমিটার। এতো দূরে মিয়ানমার থেকে গুলি এসে পড়বে ভাবিনি। নাফনদ পেরিয়ে এপাড়ে গুলি এসে পড়েছে। আমরা এখন খুব আতঙ্কে আছি।’
সীমান্তের বাসিন্দারা জানায়, আবার বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে চরমান যুদ্ধে এপাড়ে গোলার বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে টেকনাফের নাইট্যং পাড়া, পৌরসভার জালিয়া পাড়া, সদরের নাজির পাড়া ও সাবরাংয়ের শাহপরীর দ্বীপের ওপাড়ে আশিক্কা পাড়া, সুদাপড়া, পাতংজা, হারি পাড়া, বাইন্ন্যা পাড়া, সিকদার পাড়ার লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের রাজ্যে চলমান যুদ্ধে কারনে প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতি মধ্য অনেকে এপারে ঢুকে পরেছে। তবে সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার রেখেছে।
টেকনাফ-২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো.মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির কারনে সীমান্তে যাতে অনুপ্রবেশ না ঘটে সেজন্য আমরা বিজিবির টহল জোরদার রেখেছি।’
মিয়ানমারের যুদ্ধের কারনে আতঙ্কের কথা বললেন সীমান্তের পৌরসভার জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী নুর হোসেন। নাফনদ ঘিরে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। নাফ ঘিরে যেমন রয়েছে সুখস্মৃতি, তেমনই আছে নানা কষ্টের দিনলিপিও।
নুর হেসেন বলেন, ‘দুই দিন ধরে নাফের ওপার থেকে যেভাবে বিকট গোলার শব্দ পাচ্ছি, এর আগে কখনও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। রাতে কানের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমাতে হয়। স্থলসীমানা হলে এতক্ষণ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতো। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটত। এই নাফনদ আমাদের সীমান্তবর্তী বসবাসকারী মানুষকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। নাফ নদ পেরিয়ে ওপারের গোলা এখনও এখানে এসে পড়েনি। যদি বান্দরবানের তুমব্রæ, ঘুমধুমের মতো স্থলসীমানা থাকলে এমন সময়ে জন্মভিটা ছেড়ে অন্যত্রে চলে না গিয়ে উপায় ছিল না।
শাহ পরীর দ্বীপ বাজার পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘ওই দিন সকালে ১টি গুলি এসে পড়েছে আমার বাসার আঙ্গিনার গাছের ডালে। তখন ঘটনাস্থলে কেউ থাকলে গায়ে লাগতে পারত। আরও গুলি এসে পড়ার ভয়ে ঘরের লোকজন বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না। পরে গুলিটি বিজিবির কাছে হস্তান্তর করি। এত দিন বোমার শব্দে এলাকার মানুষ আতঙ্কে ছিলেন, এখন নতুন আতঙ্ক হিসেবে যুক্ত হয়েছে ওপারের গুলি।’
শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার জেলে নুর মোহাম্মদ বলেন, সকাল থেকে মিয়ানমার ওপারে মর্টার শেল ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনা যাচ্ছে। রাখাইনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই পল্লির অন্তত ৫০০ জেলে নাফ নদে মাছ শিকারে নামতে পারছেন না। আয়রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। রাখাইন যুদ্ধ আরও তীব্র হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় জেলেপল্লির মানুষ দু:চিন্তায় আছেন।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী। তিনি বলেন, শাহপরীর দ্বীপের কয়েকটি স্থানে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি এসে পড়েছে। রাখাইন রাজ্যে বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে। এ ব্যাপারে সীমান্তের প্রতিটি গ্রামে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা নিয়ে লোকজনকেও সতর্ক করা হচ্ছে। এই সুযোগে কোন রোহিঙ্গা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’